অর্থনীতি, সমাজ বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যেই এখনো তাঁদের অবস্থান। তবে নারীদের এগিয়ে নিতে নানা রকমের উদ্যোগ রয়েছে, যার মধ্যে আছে কিছু আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থাও। অর্থাৎ আর্থিক ক্ষেত্রে একজন নারী পেতে পারেন বিশেষ কিছু সুবিধা।

এসবের মধ্যে রয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য জামানতবিহীন ও কম সুদে ঋণ। নারীরা বিনিয়োগের বিশেষ সুযোগ পাচ্ছেন সঞ্চয়পত্রে। এ ছাড়া তাঁদের আয়ের ওপর রয়েছে বাড়তি করছাড়–সুবিধাও।

ফলে একটা সময় বেশ পেছনে পড়ে থাকা নারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেকেই ভালো উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলোয় অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। এমন নানামুখী উদ্যোগ নারীদের এনে দিয়েছে আর্থিক স্বাধীনতা।

এগিয়ে যাওয়া নারীদের এখন অনুসরণ করছেন আরও অনেকেই।

সঞ্চয়পত্র

 

ঋণ পেতে যত সুবিধা

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় তাঁদের জন্য রাখা হয়েছে পৃথক ডেস্ক। এসব ডেস্কে নারী উদ্যোক্তাদের সেবা দিতে রয়েছে পৃথক কর্মকর্তা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী কর্মকর্তারাই এ দায়িত্ব পালন করছেন। এ উদ্যোগ তদারক করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছে পৃথক সেল।

ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে (এসএমই) যে ঋণ দেয়, তার ১০ শতাংশ অর্থ নারী উদ্যোক্তাদের দিতে বলা হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ ১৫ শতাংশে উত্তীর্ণ করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রতিবছরই ব্যাংকগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ এসএমই খাতে ঋণ হিসেবে বিতরণ করে। ফলে, ভালো কোনো প্রকল্প হাতে থাকলে একজন নারী উদ্যোক্তা এসএমই ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন।
নারী উদ্যোক্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃ অর্থায়ন কর্মসূচির আওতায় ৭ শতাংশ সুদে ঋণ পাচ্ছেন। এ ছাড়া করোনাভাইরাস মহামারির অভিঘাত থেকে রক্ষা পেতে ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য ৪ শতাংশ সুদে যে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ কর্মসূচি চালু রয়েছে, তা থেকেও ঋণ পাচ্ছেন নারীরা।

প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের জন্য রয়েছে আরও কিছু ঋণসুবিধা। নারী উদ্যোক্তাদের ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন ঋণসুবিধা রয়েছে। ঋণ আবেদনের ১০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত দিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মেয়াদি ঋণের তিন থেকে ছয় মাস ঋণ পরিশোধে বিরতিরও সুবিধা রয়েছে নারীদের ক্ষেত্রে।

বেসরকারি খাতের ব্র্যাক, সিটি, ইস্টার্ণ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, স্টান্ডার্ড চার্টার্ডসহ কয়েকটি ব্যাংকে নারীদের জন্য রয়েছে বিশেষায়িত সেবা। এ ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি, লংকাবাংলা, আইডিএলসিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিশেষ সেবা রয়েছে। এসব সেবা মিলছে নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ ডেস্কে।

ব্যাংকঋণ পাওয়া এখন আগের তুলনায় সহজ হলেও এখনো বেশির ভাগ নারী উদ্যোক্তা পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়েই ব্যবসা পরিচালনা করেন।

 

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে সুবিধা

সরকার ১৯৯৭ সালে চালু করে পরিবার সঞ্চয়পত্র। ২০০২ সালে একবার তা বন্ধ করে দেওয়া হলও ২০১০ সাল থেকে তা আবার চালু করা হয়। তবে যে কেউ পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন না। ১৮ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সের যেকোনো বাংলাদেশি নারী, শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী ও পুরুষ এবং ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী বাংলাদেশি নারী ও পুরুষেরা কিনতে পারেন পরিবার সঞ্চয়পত্র।
এ ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ সুবিধা পান নারীরা। অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক যেকোনো নারী পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন।

পেনশনের সঞ্চয়পত্র ছাড়া সাধারণ সঞ্চয়কারীদের জন্য নির্ধারিত পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রেই সবচেয়ে বেশি মুনাফা পাওয়া যায়। চালু সঞ্চয়পত্রগুলোর মুনাফার হার কমিয়ে আনা হলেও এখনো এ সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২। এ হার অবশ্য ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। ১৫ লাখ ১ টাকা থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১০ দশমিক ৫। আর ৩০ লাখ ১ টাকা থেকে তার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষে মুনাফা সাড়ে ৯ শতাংশ।

পরিবার সঞ্চয়পত্রে মুনাফা নেওয়া যায় মাসিক ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে মুনাফার পরিমাণও নির্ধারণ করা আছে। যেমন ১০ হাজার টাকায় ৯৬ টাকা, ২০ হাজার টাকায় ১৯২ টাকা, ৫০ হাজার টাকায় ৪৮০ টাকা, ১ লাখ টাকায় ৯৬০ টাকা, ২ লাখ টাকায় ১ হাজার ৯২০ টাকা এবং ৫ লাখ টাকায় ৪ হাজার ৮০০ টাকা। এসব মুনাফা থেকে বাদ যাবে ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর।

তবে পরিবার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ৫ লাখ টাকার নিচে হলে মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ হবে। বিনিয়োগ এর চেয়ে বেশি হলে উৎসে কর হবে ১০ শতাংশ।

মাসিক মুনাফা নেওয়ার পর পাঁচ বছরর মেয়াদ শেষে মূল টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। মেয়াদপূর্তির আগে নগদায়ন করলে মুনাফা হিসেবে নেওয়া টাকা কেটে রেখে বাকি অর্থ ফেরত দেয় সরকার। এক লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনে মেয়াদপূর্তির কত আগে তা ভাঙালে কত টাকা ফেরত পাওয়া যাবে, সেটি ঠিক করা আছে। যেমন প্রথম বছর চলাকালে এক লাখ টাকা ভাঙালে কোনো মুনাফা পাওয়া যাবে না।

তবে দ্বিতীয় বছর চলাকালে ভাঙালে মুনাফাসহ পাওয়া যাবে ১ লাখ ৯ হাজার ৫০০ টাকা। এভাবে তৃতীয় বছর চলাকালে ভাঙালে ১ লাখ ২০ হাজার, চতুর্থ বছর চলাকালে ১ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ এবং পঞ্চম বছর চলাকালে ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা পাওয়া যাবে।

বর্তমানে ১০ হাজার, ২০ হাজার, ৫০ হাজার, ১ লাখ, ২ লাখ, ৫ লাখ এবং ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের পরিবার সঞ্চয়পত্র রয়েছে। এসব সঞ্চয়পত্র কেনা যায় জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব তফসিলি ব্যাংক ও ডাকঘর থেকে। একই জায়গা থেকে সঞ্চয়পত্র নগদায়ন বা ভাঙানো যায়।

একজন ব্যক্তি একক নামে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকার একধরনের সঞ্চয়পত্র কিনতে পারলেও পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনা যায় ৪৫ লাখ টাকার। তবে একজন ব্যক্তি একক নামে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারেন।

 

আয়করে ছাড়

নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আয়করেও রয়েছে বিশেষ ছাড়। সরকারের বক্তব্য, দেশে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এই ছাড় দেওয়া হয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৭০ লাখ টাকা। অর্থাৎ নারী উদ্যোক্তারা বছরে ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করলে কোনো কর দিতে হবে না।

এ ছাড়া ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের ক্ষেত্রেও নারী করদাতারা কিছুটা ছাড় পেয়ে থাকেন। বর্তমানে পুরুষ করদাতাদের বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা। নারীদের ক্ষেত্রে এ সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা।
জাতীয় মহিলা সংস্থা

নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের আওতায় জাতীয় মহিলা সংস্থাকে ২০০৩-০৪ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রায় ৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

সংস্থাটির ১০৮টি জেলা ও উপজেলা শাখার মাধ্যমে মাথাপিছু ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে।

কতটা সুবিধা হচ্ছে

তৃণমূল নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব গ্রাসরুটস উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস বাংলাদেশ (এজিডব্লিউইবি) ও প্রমিক্সকো গ্রুপের চেয়ারম্যান মৌসুমী ইসলাম মনে করেন, নারীদের জন্য কাগজেকলমে নানা সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তবে তার সবকিছু এখনো ভালোভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

প্রথম আলোকে মৌসুমী ইসলাম বলেন, যেসব নারী নিজ উদ্যোগে ব্যবসা করে এগিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা কোনো প্ল্যাটফর্মে জায়গা পাচ্ছেন না। আবার যাঁরা অপ্রচলিত পণ্যের ব্যবসা করছেন, তাঁরা কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না। উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিতে নারীদের এগিয়ে রাখতে বিশেষ কোটা রাখতে হবে। তাহলে নারীদের প্রকৃত উন্নয়ন হবে।

মৌসুমী ইসলামের পরামর্শ, নারীদের জন্য সুবিধার কথা শুধু নথিপত্রে না রেখে সেগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

সুত্রঃ প্রথম আলো

Related Post

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *